নিজের রেডিও
মোঃ শাহাদত হোসেন
মোঃ শাহাদত হোসেন
‘উত্তরণ নিউজ লেটার' যখন রেডিও নিয়ে তার প্রথম প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেয়, তখনই আগ্রহ ভরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ প্রতিযোগিতায় লেখা পাঠাব। কিন্তু লিখতে বসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম-কি লিখব! কেননা বিগত ২৪ বছরের ডি-এক্সিং সময়ের অধিকাংশটাতেই আমার নিজের কোনো রেডিও ছিলো না এবং ২৪ বছরের মধ্যে কখোনই আমি কোনো রেডিও কিনিনি। অথচ বিগত দু'যুগ ধরে রেডিও আমার নিত্য সঙ্গী, সবচে বড় বন্ধু, সবচে প্রিয় আপনজন।
বিষ্ময়ে অবিভূত হতে হয়! নিজের কেনা রেডিও ছাড়া দীর্ঘ দু'যুগ ধরে ডি-এক্সিং করছে, এমন ব্যক্তি দ্বিতীয়টি আর আছে কিনা আমার জানা নেই। পাঠকদের জানা থাকলে, তার যোগাযোগ ঠিকানা আমাকে পাঠানোর অনুরোধ রইল।
১৯৮২ সাল। আমি তখন ঢাকার রামপুরা একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। যোগাযোগ হয় ইকবাল ভাইয়ের বাংলাদেশ ডিএক্স ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবের সাথে। আগ্রহ সৃষ্টি হয় রেডিও শুনার, বিশেষ করে শর্টওয়েভ বিদেশী বেতারের অনুষ্ঠান শুনার। কিন্তু আমার নিজের বা বাসায় কোনো রেডিও নেই। দ্বারস্থ হলাম পাশের বাসার শাহজাহানের, যে আমার দূরসম্পর্কীয় কাজিন হয়। ওর ছিলো সনি ফোর ব্যান্ড রেডিও কাম রেকর্ডার। প্রতিদিন সকাল আর সন্ধ্যায় ওর বাসায় শর্টওয়েভে বিদেশী বেতারের অনুষ্ঠান শুনতাম, রিসেপশন রিপোর্ট ও চিঠি পাঠাতাম, পেতাম বৈচিত্রময় উপহার সামগ্রী।
রেডিও শুনার সুবাধেই শাহজাহানের সাথে অত্যাধিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ওর বাবা-মা-ভাবীর সাথে সৃষ্টি হয় আত্মিক সম্পর্ক। অতি অল্পদিনেই ওদের সাথে আমার সম্পর্কটা এমন হয়ে গেলো যে, ওর রেডিওটাই হয়ে গেলো আমার রেডিও, ওদের বাসাই হয়ে গেলো আমার বাসা। ফলে আমি নিজে রেডিও কেনার কথা ভুলেই গেলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠার আগ পর্যন্ত আমার এ মধুময় জীবন অব্যাহত ছিলো।
আমি যদি কোনো কারণে কোনো দিন নির্দিষ্ট সময়ে রেডিও শুনতে না যেতাম তাহলে শাহজাহানের বাবা-মা উৎকণ্ঠায় থাকতেন, শাহজাহান এসে আমাকে ডেকে নিয়ে যেত। অধিকাংশ দিনই সকাল আর রাতের খাবার খেতে হতো ওদের বাসায়। কোনোদিন যদি খেতে খুব আপত্তি করতাম, ওর মা বলতো, ‘ব্যাটা, তোমার জন্যও তো রান্না করেছি। এখন না খেলে যে তা নষ্ট হবে। ওরা আমাকে ওদের পরিবারের একজন সদস্য ভাবতো। সে সম্পর্ক আজও অটুট আছে।
এখন ভাবি সেদিন যদি কোনোভাবে একটা রেডিও কিনে ফেলতাম তাহলে ঐ পরিবারের সাথে আমার এ সম্পর্ক সৃষ্টি হতো না। শাহজাহানের রেডিওটা শুধু আমাকে ডি-এক্সিং করার সুযোগ দেয়নি, বিশাল পৃথিবীর মধ্যে কিছু মানুষকে আপনজন করে নেবার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জিয়া হলে উঠার পরই শুরু হলো বিপদ। নিজের রেডিও নেই, হলেও কোনো রেডিও নেই (পরে অবশ্য আমার প্রচেষ্টায় হলের পত্রিকা রুমে একটা রেডিওর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো), অথচ রেডিও না শুনলে সকাল-সন্ধ্যা আমার অস্বস্তিতে কাটে। প্রতিটি সকাল আর সন্ধ্যা আমার কাছে দূর্বিসহ মনে হতো। হলে উঠার কারণে নিজের খরচও বেড়ে গেলো, ফলে তখনই একটা ভালো রেডিও কেনার কথা ভাবতেও পারছিলাম না। ঢাকা কলেজে পড়া অবস্থায় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম ছিলো অরুণ। আমি ওকে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রের আকর্ষণীয় উপহার সামগ্রী দিতাম। সেও আমার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বাসা থেকে এসে ক্লাস করে, মাঝে মধ্যে আমার রুমে এসে বিশ্রাম নেয়। ও আমার রেডিও না থাকার দুঃখ উপলব্ধি করে আমাকে কিছু টাকা ধার দেয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি সানন্দে তাতে সম্মত হই।
কিন্তু বিধি বাম। আমার আর রেডিও কেনা হলো না। অরুণ আমাকে যেদিন টাকা দেয়ার কথা, তার এক সপ্তাহ আগে ওর দুলাভাই বিদেশ থেকে আসেন। তিনি তাঁর বাসার জন্য অতি সুন্দর টুয়েলভ ব্যান্ডের ছোট একটা রেডিও নিয়ে আসেন। অরুণ তার দুলাভাইকে আমাদের দু'বন্ধুর ঘনিষ্ঠতার কথা বলে, আমার অনেক প্রশংসা করে, আমার ডি-এক্সিংয়ের কথা বলে, তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সে রেডিওটা আমাকে উপহার দেয়ার ব্যবস্থা করে।
রেডিও উপহার পেয়ে আমার রেডিও কেনার পরিকল্পনা বাতিল হলো এবং এ রেডিওটা অরুণদের পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দিলো। শুধু তাই নয়, জিয়া হলে আমার রুমমেট ও পাশের রুমের ছাত্রদের সাথেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব সৃষ্টিতে সহায়তা করে। রুমমেটরা মিলে রেডিও শুনতাম, মাঝে মধ্যে অন্য রুমের ছাত্ররাও এসে যোগ দিতো। সকলের আগ্রহে উৎসাহে আমি একটি লিস্নার্স ক্লাব গড়ে তুলি।
রেডিওটা আমার হলের জীবনটাকে বদলে দিলো। নিরানন্দ ও বিষাদময় থেকে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে ভরে উঠলো আমার জীবন। আত্মীয়-পরিজনের অভাব ভুলিয়ে দিলো রেডিওটা।
মাস্টার্স পরীক্ষার পর পরই রেডিওতে ক্রটি ধরা পড়লো। মোহাম্মদপুরে আমার এক বন্ধুর রিপিয়ারিংয়ের দোকান আছে। ওকে দিলাম মেরামত করতে। ঠিক করে দিচ্ছি দিচ্ছি করে সে দেরি করতে লাগলো। চাকুরি নিয়ে চলে এলাম, রেডিওটা আর আনা হলো না। জানিনা আমার দীর্ঘ ৬/৭ বছরের সাথী সে রেডিওটা এখন কোথায়, কার কাছে, কেমন আছে? মাঝে মধ্যে ঐ রেডিওটার জন্য আমার মনটা আনচান করে উঠে। বুকের মাঝে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়।
সুনামগঞ্জ এসে উঠলাম আমার এক নানার বাসায়। তিনি সৌখিন ও সচেতন মানুষ। বিদেশি বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনার জন্য তাঁর রয়েছে অতি উন্নতমানের একটি রেডিও। ফলে অতি সহজেই আমার রেডিওর অভাব দূর হলো। তবে মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে খুনসুটি লেগে যেতো। আমি এক বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে চাইতো তিনি অন্য বেতারের। আমার দরকার রিসেপশন রিপোর্ট লেখা, আর নানার দরকার খবরের।
চাকুরি, বিয়ে, বাসা, সংসার স্থানীয় সামাজিক কর্মকান্ড নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কোথা দিয়ে যে বেশ ক'টি বছর চলে গেলো। ভাবছি একটা উন্নতমানের রেডিও কিনবো, কিন্তু এবারও বিধি বাম। রেডিও আর কেনা হলো না। ২০০৫ সালের প্রারম্ভে ডয়চে ভেলে আমাকে একটি ডিজিটাল রেডিও উপহার হিসেবে পাঠালো, GRUNDIG
Yacht Boy 80. সে থেকে এটি আমার নিত্য সঙ্গী।
ভাবছি, উত্তরণের পাঠক বা সম্পাদক হয়তো ভাবছেন, রেডিও নিয়ে মজার মজার ঘটনা লেখার ঘোষণা দিলাম- আর তিনি লিখে ফেললেন দীর্ঘ এক রচনা। কিন্তু আপনারা ভেবে দেখুন, নিজের কেনা রেডিও ছাড়া একজন ডি-এক্সারের ২৪ বছর পার করার চেয়ে বিষ্ময়কর ঘটনা আর কি হতে পারে!
- সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, সুনামগঞ্জ থেকে